মানুষ প্রকৃতি নির্ভর। প্রকৃতি মানুষেরই অজৈব দেহ। প্রকৃতি ও মানুষ মিলেই প্রাণসঞ্চার ও জীবের অস্তিত্ব। প্রাকৃতিক পরিবেশ বা প্রকৃতি মানুষের কাজকর্মের ও জীবনযাত্রা প্রণালী নির্ধারণের মূল নিয়ন্ত্রণ। পরিবেশ নিয়ে সারা বিশে^ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। শিল্পায়ণ, উন্নয়ন ও পারমানবিক শক্তি অর্জনের প্রতিযোগিতায় বিশ^ আজ প্রকৃতিকে করছে শাসন। যার ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, জলবায়ু ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, সুনামী, দাবানল, ভ‚মিকম্প, টর্নেডোসহ বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দূর্যোগ। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মহামারী প্রাণঘাতি ভাইরাসও। পরিবেশ বিপন্নতায় প্রাণের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
পরিবেশ ও মানুষের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে অনেক গবেষণা। ভৌগলিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সম্পর্ককে তিনটিভাবে দেখা হয়। এগুলো হলো নিয়ন্ত্রণবাদ(Determinism), সম্ভাবতাবাদ(Possibilism), নব নিয়ন্ত্রণবাদ(Neo-Determinism)।
যে তাত্তি¡ক দৃষ্টিকোন থেকে সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কার্যকালাপ, জীবনযাত্রার মান এবং উন্নয়নকে প্রকৃতির উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে বিশ্লেষণ করা হয় তাকে নিয়ন্ত্রণবাদ( Determinism) বলে। ভ‚গোলবিদ ফ্রেডারিক র্যাটজল, এলেন চার্চিল সেম্পেল, হান্টিংটনের মতে,‘মানুষ হল নিষ্ক্রিয় এজেন্ট যার উপর প্রাকৃতিক বিষয়গুলো কাজ করছে এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’
অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ভৌগলিক তাত্তি¡ক পদ্ধতি হল সম্ভাবনাবাদ(Possibilism)। এ মতবাদের প্রবক্তা লুসিয়েন ফেবর, ক্যামিল ভ্যালু, ভিদার দ্যা লা বøাশের মতে, ‘পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই। মানুষ সক্রিয়ভাবে তার নিজস্ব ভাবনা পছন্দ ও বাছবিচার দ্বারা মানুষের সামাজিক উন্নতির পথ নির্দেশ করে।’
নিয়ন্ত্রণবাদ ও সম্ভাবনাবাদের দ্ব›দ্ব থেকে এক নতুন মতবাদ নব নিয়ন্ত্রণবাদ(Neo-Determinism) ধারণাটির জন্ম। এর মূল বক্তব্য হল- প্রাকৃতিক পরিবেশ বা প্রকৃতি মানুষের কাজকর্মের ও জীবনযাত্রা প্রণালী নির্ধারণের মূল নিয়ন্ত্রণ হলে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাভাবনাও সক্রিয় ভ‚মিকা তার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।’ এ মতবাদের প্রবক্তা গ্রিফিথ টেলরের মত হল, ‘প্রকৃতির পরিবেশকে দেখ ও সম্ভবনার পথে এগিয়ে চলো।
মার্কসের মতে, ‘মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রকৃতির ওপর প্রযুক্ত শ্রমের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ।’
মার্কস তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির আধিপত্য প্রকৃতিকে কলুষিত করছে। প্রকৃতির প্রতি এই আচরণ অত্যন্ত ঘৃণ্য। জলের মাছ, আকাশের পাখি, মৃত্তিকার উপরের উদ্ভিদ-সব কিছুকেই পরিণত করা হচ্ছে সম্পত্তিতে। এটা অসহনীয়। সমস্ত জীবকে এই বন্ধন থেকে মুক্ত করা চাই।’
পরিবেশ নিষ্ক্রিয় নয়। যেকোনো জীবিত প্রাণী- যাদের মধ্যে মানুষও পড়ে, মানুষের সামাজিক ক্রিয়াও পড়ে, তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। পরিবেশের ওপর মানবদেহের প্রভাব কাজ করে। একইসঙ্গে পরিবেশও মানবদেহের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে উভয়েরই পরিবর্তন ঘটে।
পরিবেশ ও মানুষের সাথে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে অবহেলা করে উন্নয়ন ও শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে পুরো বিশ^। মেতে উঠেছে পারমানবিকের মত পরিবেশ বিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনে। মানুষ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে প্রকৃতিকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা করছে। এসব প্রচেষ্টা সাময়িক লাভজনক হলেও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে গোটাবিশ^। যে যেভাবে পারছে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে ব্যবহার করছে। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু।
এবার সারা বিশে^র নজর পড়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে। ২০১৫ সালে প্যারিসে এক বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি হয়। যা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশে^র দেশগুলোকে একতাবদ্ধ করে। ঐ সময় দুইশটির মতো দেশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে যে ঐক্যমত্য পোষণ করেছে তাকে অনেক পর্যবেক্ষকই ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ বলে বর্ণনা করছেন।
যেই চুক্তির মূলে ছিলো-বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম করা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা করা হয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে গরিব দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর ‘জলবায়ু তহবিল’ দিয়ে সাহায্য করা।
কিন্তু প্যারিস চুক্তিতে এসব নীতি থাকলেও বাস্তবে উন্নত দেশগুলো এসব নিয়ম মানতে নারাজ। পরবর্তী ২০১৯ এর সম্মেলনের পূর্বেই যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি প্রত্যাখানের ঘোষণা দেয় এবং সম্মেলনে অংশ নেয়নি চীন, জাপান, ভারতসহ উন্নত রাষ্ট্রের নেতারা। কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, পরিমাণ শতকরা ১৪ দশমিক ৬ ভাগ। চীন এক নম্বরে। নিঃসরণ করে শতকরা ২৭ দশমিক ২ ভাগ। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় দেশ না চাইলে জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না, এটাই ধরে নেয়া যায়। ফলে জলবায়ু চুক্তি নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বল্পউন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো। আর পরিবেশ পড়বে মারাত্মক ঝুঁকিতে।
নিউটনের তৃতীয় সুত্রের মত প্রকৃতিরও প্রতিক্রিয়া রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-নদীর জীবন চক্র একটি প্রাকৃতিক নিয়মে বিবর্তিত হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার ব্যাঘাত ঘটলে নদী আগ্রাসী হয়ে এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি তুললে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রকৃতিতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে চরম মাত্রায় নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষকে হতে হয় সম্পদ, জমি ও বাস্তুহারা।
অন্যদিকে বেশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরুতে বরফ গলা শুরু হয়। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে উপক‚লীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ত পানীর প্রভাবে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটঁছে। প্রতিবছরই ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ। কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। আবার বন্য প্রাণীরা লোকালয়ে চলে আসছে। হুমকিতে পড়ছে জনজীবন।
পুজিঁবাদী এই সমাজে মানুষ হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি ও আত্মকেন্দ্রীক। সকল দেশেই অর্থনৈতিক এক অস্বাভাবিক যুদ্ধে লিপ্ত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামরিক সক্ষমতার প্রতিযোগিতাও। প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রায্য করে গড়ে তুলছে কল কারখানা, পারমানবিক শক্তি কেন্দ্র, পারমানবিক অ¯্র ইত্যাদি। যা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ কলুষিত করছে পৃথিবীর বায়ু, মাটি, পানি। ফলে বিপন্ন ও বিপর্যয়ে পড়ছে মানবজীবন।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেমন রয়েছে ধারাবাহিকতা তেমনি প্রকৃতিরও আসে নিজস্ব নিয়মতান্ত্রিকতা। অন্তত মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়কাল তাই সংকেত দেয়। বিভিন্ন সময়ে বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে ছড়িয়েছে সংক্রমিত রোগ। আধুনিক বিশে^র ইতিহাসে মারাত্মক মহামারী হয় ‘বুবোনিক প্লেগ’ ১৬৬৫ সালে। তারপর দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ ‘কলেরা’। ১৮৫৫ সালে শুরু হয় ‘প্লেগ’ নামক মহামারি। ১৮৮৯ সালে ‘রাশিয়ান ফ্লু’ ছড়িয়ে যায় সারা বিশে^। ১৯১৮ সালে ঘটে আরেক মহামারি। তারপর শুরু হয় ‘স্পেনিস ফ্লু’। ১৯৫৭ সালে চীন থেকে বিস্তার করে ‘এশিয়ান ফ’¬ু। ১৯৬৭ সালে আঘাত হানে ‘ইবোলা ভাইরাস’। ২০২০ সালে হানা দিলো ‘করোনা ভাইরাস’। এসব ভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ । করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে দুই লাখের অধিক মানুষের। আক্রান্ত হয়েছে ত্রিশ লাখ মানুষ। ছড়িয়েছে প্রায় ২১০টি দেশে। পুরো বিশ^ই রয়েছে বন্দি অবস্থায়। কার্যত বন্ধ সকল অর্থনীতির চাকা। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে মহামন্দার। চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন উন্নত দেশগুলো। এসব মহামারিগুলোও বার বার প্রমাণ করছে প্রকৃতির যে অধিকার তার রয়েছে অদৃশ্য এক সীমা। মানুষ যখনই এই সীমা অতিক্রম করতে গিয়ে শুধু অগ্রগতির কথা চিন্তা করছে তখনই প্রকৃতি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে ¤øান করেছে মানুষের সকল অর্জন। তাই প্রকৃতিকে শাসন বা মোকাবেলা করে নয় প্রকৃতির সাথে সহবস্থান দরকার।
Trending
- প্রকৃতিকে শাসন নয় প্রয়োজন সহাবস্থান
- পাহাড় ও হাওর ভ্রমণ: আনন্দময় ইবাদত
- Manner before Education in Japan
- দাওয়াতী কাজই মুমিন জীবনের মুল মিশন
- US Nod to Nato for Sending Fighter Jets to Ukraine Finds no Takers
- U.S. Warns Financial Institutions to be on Watch for Russian Sanctions
- Everything You Need to Know About Personal Finance: Pocket-sized Edition
- EXCLUSIVE: US Tax Reform to Focus on Individuals, Natural